অবেলার ডাক।। ২০১৯ সাল, শরতের এক স্নিগ্ধ সকালে বেরিয়ে পড়েছি গ্রাম থেকে শহরের দিকে। উদ্দেশ্য প্রাইভেট শেষ করে কলেজে গিয়ে সপ্তাহিক পরিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরা। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে কে যেনো বলেছিলো কলেজে তেমন ক্লাস করতে হয় না, এমনকি বই দুই একটা নিয়েই ক্লাস করা যায় কিন্তু আমি সেই ব্যক্তিতে নিয়ম করে মনে মনে বকা দিয়ে প্রতিদিন এক গাদা বই নিয়ে প্রাইভেট পড়ে ক্লাস করে বাড়ি ফিরতাম। আজ শনিবার, আমাদের সাপ্তাহিক পরিক্ষার দিন।কিন্তু নিত্যদিন এই প্রাইভেট, ক্লাস, পরিক্ষা, কলেজের কঠিন নিয়মকানুনে আমরা যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রাইভেট পড়ছিলাম হঠাৎ বান্ধুবী খুর্শিদা বললো আজ আমরা পরিক্ষা দিবো না। যেখানে পরিক্ষা দিয়ে রেজাল্ট খারাপ করলে অভিভাবককে অধ্যক্ষের সাথে কথা না বলিয়ে আবেদন না দিয়ে ক্লাস করতে দেওয়া হতো না, সেখানে এটা ছিলো কঠিন সিদ্ধান্ত। কিন্তু ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে সবাই বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। পথিমধ্যে আমার কলেজে পরিচিত হওয়া খুশি নামের বান্ধুবী বললো চলো তোমরা আমার সাথে। আজ আমি গ্রামের বাড়িতে যাবো। (গ্রাম দূরে হওয়ায় সে শহরের পাশে বড় বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনার করতো)। সবসময় কোথাও যেতে না বলা আমিটাও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। রাস্তায় সিদ্ধান্ত ফাইনাল হলো, এই প্রথম পরিক্ষা ফাঁকি দিয়ে আমরা তিনজন বান্ধুবী শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর তীরে গিয়েছিলাম। নদীর পাশেই ছিলো খুশিদের বাড়ি। আমার আর খুর্শিদার ভয় লাগলেও খুশির মুখে ছিলো বাড়িতে ফেরার আনন্দ। ভয় কাটিয়ে উঠতে দেখছিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য। আমি ছোট থেকেই ছিলাম প্রকৃতিপ্রেমি। দেখছিলাম ঝঁকঝঁকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘে,ফুলের শোভা আর শস্যের উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা আমার প্রিয় ঋতু শরতের সৌন্দর্য। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছিলো নদীর ছোট ছোট শাখাপ্রশাখা। দিগদিগন্ত পেরিয়ে মেঠোপথ থেকে দেখছিলাম ফসলের মাঠের মাঝে একটি বাড়ি। হ্যা এটাই ছিলো খুশিদের বাড়ি।

ফসলি ক্ষেতের সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম খুশিদের বাড়ির দিকে। মাঝে পথে হাঁটতে গিয়ে ঠাস কর পড়ে গেলো আমার বান্ধবী খুর্শিদা। ওকে উঠিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম তারপর খুশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম যমুনা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। যদিও বান্ধুবী খুশিদের গ্রাম ছিলো এটা, তবুও নিরাপত্তার জন্য খুশির এক বড় ভাইয়াকে সাথে নিলাম।তিনি আমাদের নদীর তীরে বসার জন্য পাশের বাড়ি থেকে চেয়ার নিয়ে আসলেন। যমুনা নদীকে এই প্রথম তার তীরে বসে দেখছিলাম।আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উরে যাচ্ছিলো একে একে পাখির ঝাঁক। শিমুল তুলার মতো ভেসে চলছিলো সাদা মেঘের খেয়া। নদীর তীরে বসে অনেক জন নদীতে ছিপ ফেলে স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। প্রকৃতির এতো সৌন্দর্যের ভীড়ে বাড়ি ফেরার কথা যেন ভুলে গিয়েছিলাম। এভাবে আমরা ঘোরাঘুরি শেষ করলাম কিন্তু কলেজের কঠোর নিয়মকানুন এর মধ্যে ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় নদীর সেই সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করার আপসোস হচ্ছিলো খুব। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। আমি আর খুর্শিদা খুশিদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ফসলের ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে রাস্তার সন্ধান করছিলাম আর গুনগুন করে গান গাইতেছিলাম। সবুজ শস্যের পত্রপল্লবের গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে নীল আকাশে উড়ে যাছিলো। অনেক সময় হাঁটার পর আমরা রাস্তার সন্ধান পেলাম এবং খুশি আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্য। আমরা গাড়ির জন্য তৃষার্ত চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছিলাম এবং বাড়িতে গিয়ে কি অজুহাত দিবো সেটার জন্য পরিকল্পনা চলছিলো।হঠাৎ খুর্শিদা বললো টেনশন নিও না ওর সম্পর্কে আমার তোমার বাড়ির সবাই তেমন জানে না,বলবো খুশির বাবা মারা গিয়েছো তাই গিয়েছিলাম তারপর এভাবে রাস্তায় পরিকল্পনায় কত জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি ভাবছিলাম এই অজুহাতে আজ কি পাড় পাবো আর খুশিদাও কি আদৌও পাবে ?

আয়শা সিদ্দিকা, সিরাজগঞ্জ।