গন অভ্যুত্থান পরবর্তী অনৈক্য, বিভাজন ও বিপ্লবীদের জন্য প্রস্তুত ফাসির মঞ্চ প্রবাদ

বালী তাইফুর রহমান তূর্য,সমাজকর্মী ও লেখক। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জুলাই গনহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান, গন অভ্যুত্থানের পক্ষ বিপক্ষ এবং “দোসর” শব্দটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে প্রচুর।সামাজিক অনুষ্ঠান,পুরস্কার বিতরণ বা বিয়ে,ইফতারের সময়ের অনেক ছবি নিয়ে যে হাস্যকর রাজনীতি শুরু হয়েছে তা স্রেফ আমাদের সামাজিক নৈতিক অবক্ষয় এবং সংকীর্ণ হতে বসা মানুষিকতার বহিঃপ্রকাশ।

জুলাই প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করলেই অনেক কিছু ভেসে ওঠে।যখন ছাত্ররা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলো তখন প্রথমদিকে আওয়ামী লীগও চুপচাপ ছিলো।যখন আওয়ামী লীগ এটাকে হুমকি মনে করলো তখনই ছাত্রলীগ ও পুলিশ লাগিয়ে দিলো।যেদিন ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মারলো,হামলা করলো সেদিনের সেইসব ঘটনা,ছবি, সংবাদ দেখেই সাধারণ মানুষের মনে ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন শুরু হলো।এবং আন্দোলনকে সমর্থন করাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো যারা আওয়ামী লীগের ভোটার ছিলো বা সমর্থক ছিলো অথবা ততকালীন সরকারি দল বা বিরোধী দলের নেতাদের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক ছিলো।আমরা অনেক ছাত্রলীগ করা ছেলেদের দেখেছি যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গিয়ে এই আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে উপস্থিত ছিলো।

এরপরে যেদিন থেকে সাধারণ ছাত্রদের উপর গুলি করা শুরু হলো সেদিন থেকেই একেবারেই সাধারণ জনতা শুধু ছাত্রদের বাচাতে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলো।রাজপথে অসংখ্য লোক ছিলো যারা একে অপরকে চিনতো না কিন্তু এক সাথে জুলাই আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করেছে।এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটারও ছিলো যারা আওয়ামী লীগের এই ঘৃণ্য কাজের ফলে তাদের বিরুদ্ধেই রাজপথে ছিলো।এটাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই,কারণ এটি না হলে অভ্যুত্থান হওয়ার মতো লোক জুলাইয়ের শুরুতেই হয়ে যেতো।জুলাইয়ের শেষে এবং আগস্টের শুরুতে আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকলে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি চলতে থাকলেও সাধারণ জনতা হুহু করে এই আন্দোলনে নিজেদের বিসর্জন দিতে ছাত্রদের ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিলো যার তরতাজা প্রমান এখনো জুলাই আহতরা।তাদের মধ্যে সবাইই ছাত্রদলের কর্মী নন।

সেইসব সাধারণ জনতার মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের ভোটার ছিলো তাদের সাথে জুলাইতেই লীগের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং তারা লীগের চির শত্রুতে পরিনত হয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগা জাতি সেই পলাশীর প্রান্তরের পরবর্তী পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে।যারা ছাত্রদের বাচাতে রাস্তায় ঝাপিয়ে পরলো,খাবার খাওয়ালো,পানি খাওয়ালো,আশ্রয় দিলো তাদের অনেককেই এখন দোসর বলে আখ্যা দিচ্ছে অনেকেই।১৯৭১ সালের পরেও অনেক প্রকৃত যোদ্ধারা নিশ্চুপ হয়েছিলো ঘরে ফিরে ,ক্রেডিটের ভাগাভাগিতে যায়নি।এখনো তাই হচ্ছে,অতি উৎসাহ এবং দলীয়করণে এই অভ্যুত্থান প্রশ্নের মুখে পরছে বারবার।রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদেরকে প্রধান স্টেকহোল্ডার দাবি করা নিয়েই ব্যস্ত,তারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া নির্যাতিত ছাত্রনেতাদেরই এখন ছাত্রলীগ বলে চালিয়ে দিতে মরিয়া। এটা দৈন্যদশার বহিঃপ্রকাশ।এই অভ্যুত্থান ছিলো দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের।যেই পেয়ারাওয়ালা গরীব লোকটি তার সব পেয়ারা বিনা পয়সায় খাওয়ালো,যেই রিক্সাওয়ালা গুলি উপেক্ষা করে আহতদের হাসপাতালে নিলো,যেইসব মায়েরা ঘর থেকে খাবার রান্না করে এনে ছাত্রদের খাইয়ে মামলায় ফেসেছিলো,যারা ছাত্রদের জন্য তহবিল তুলে একটু পানি আর বিস্কুট কিনে খাওয়ালো তাদের সব অবদান আজ ছাত্ররা অস্বীকার করবে?

করলেও তাদের কিছু আসে যায় না, কারন তারা দেশকে ভালোবেসে সেদিন আওয়ামী লীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিলো, সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ একটি কোটা আন্দোলনকে অভ্যুত্থানে রূপ দিয়েছিলো। রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ নিজ স্বার্থে সেখানে ছিলো কিন্তু তারাও ছিলো তাও অস্বীকার করা যায় না।

অতএব অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মাথায় রাখতে হবে পতিত সরকারের কাছে অভ্যুত্থানের পক্ষের সকলেই চির শত্রুতে পরিনত হয়েছে।এখন তাতে যত বেশি বিভাজন হবে ততই তাদের ফিরে আসা বা আক্রমণের শক্তি সবল হবে।এবং অভ্যুত্থানের ক্রেডিট কারাকারি এবং পারস্পরিক অশ্রদ্ধা অনেককে তাদের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তে অনুসূচনায় ফেলে দিলে পুরো অভ্যুত্থান এবং বিপ্লব হুমকিতে মরবে।আর এই নতুন শুরু হওয়া বিভাজনের চিত্র পুরনো বলেই ইতিহাসের সেই বাক্য “বিপ্লবীদের জন্য প্রস্তুত ফাসির মঞ্চ”।

শৃঙ্খল পায়ে জড়াবার আগেই আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ পলাশী থেকে। বিভাজন ভুলে,কাদা ছোড়াছুড়ি ছেড়ে সকলের এখন ঐক্যবদ্ধ থাকার সময়।জুলাইয়ে যার অবস্থান যেখানে ছিলো সেটিই এখন তাদের পরিচয়।এর আগের সকল সম্পর্কের বিচ্ছেদ জুলাইতেই হয়ে গেছে।মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী,অতি মাত্রায় দলাদলি দেশের জন্য ক্ষতিকর।দল বা রাজনীতিটুকো শুধুমাত্র ব্যালটেই সীমাবদ্ধ থাকুক,এতেই সকলের কল্যাণ।যারা গনতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে বা উন্নত হয়েছে কোথাও এতো অতিরিক্ত রাজনীতি বা দলাদলি নেই,আর সেকারণেই তারা উন্নত।আমাদের উচিৎ উদার হওয়া,উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা নেয়া।

  • Related Posts

    শিশু বিবাহ বাংলাদেশের কিশোরী শিক্ষার্থীদের জন্য এক গুরুতর হুমকি ডাঃ জিয়া হায়দার

    বালী তাইফুর রহমান তূর্য,সমাজকর্মী ও লেখক: দেশের শিশু বিবাহ বা বাল্য বিবাহ প্রথা বন্ধে গুরুত্ব আরোপ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিশ্ব ব্যাংকের আন্তর্জাতিক পুষ্টিবীদ ডা:জিয়াউদ্দীন হায়দার।সামাজিক…

    নলছিটিতে প্রথমবারের মতো তরুণদের অংশগ্রহণে প্রতীকী পৌরসভা পরিচালনা সভা

    বালী তাইফুর রহমান তূর্য, নলছিটি প্রতিনিধি।। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার কাঠামোয় তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশে আয়োজন করা হলো “তরুণ জনপ্রতিনিধি সিমুলেশন– নলছিটি পৌরসভা সংস্করণ”। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক নন-প্রফিট সংস্থা CARO…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *